মিছিল

অধিকার শব্দটি কানে যেতেই,
দ্রুত পায়ে মিছিলে জুড়ে গেছে অর্ধভুক্ত কিছু টোকাই কিশোর,
ওদিকে,
উৎসুক ছাপাখানার এক বৃদ্ধ কেরানিও মেসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন
অসংখ্য কিলবিলে সংক্ষুব্ধ পিপড়ের মতো এগিয়ে আসা তপ্ত মিছিলের দিকে।
হয়তো কিছুটা ঘোরের মধ্যেই, অথবা,
বুক ভরা আজন্ম ক্রোধ উঠলে উঠে
সম্মিলিত তালে তাল, লয়ে লয় ও মিছিলের সহজাত উত্তাপে উত্তাপে
মিলেমিশে আচমকা কখন যেনো তাকেও করে ফেলেছে মিছিলের অনিবার্য একজন।

মিছিল যখন ক্রোধে ভাঙছিলো সড়কের ধাতব ডিভাইডার
নিজের শীর্ণ পেশীর মধ্যেই হঠাৎ কেমন যেনো অনুভব করেন একটা অচেনা রাক্ষুসে টান।
ডিভাইডার শব্দটিকে বরাবরই তার খুব অপছন্দ,
তাই নিজের অজান্তেই কখন অনার্য এক অসুর ভর করে তার হাতে,
আচমকা হাতে উঠে আসে আধখানা উন্মূল ধাতব ডিভাইডার।
ডিভাইডারহীন রাস্তার এপার ওপার এখন সব সমান,
মিছিলের তরুন ছাত্র আর আপাত নির্বিষ বৃদ্ধ গৃহীর মধ্যে এখন আর কোন ভেদ নেই।

ওরা যখন চকচকে কালো এসিউভিতে দিচ্ছে আগুন,
দৌড়ে গিয়ে মেসের যৌথ রান্নাঘর থেকে আধ বোতল
নীল কেরোসিন এনে তিনি ঢেলে দিলেন তাতে,
গাড়ির তেলতেলে সিট থেকে দাউ দাউ শিখা নেচে উঠে ছুঁয়ে ফেললো
উঁচু পৌর ল্যাম্পপোস্ট আর তারও ওপরে
এগারো হাজার ভোল্ট খোলা ট্রান্সমিশন লাইন।
কেরানি এবার বিস্মিত চোখে দেখেন শুধু আগুন নয়
তার রক্তের মধ্যেও নাচছেন একজন পাগলা হেলাল হাফিজ।
মনে হচ্ছিলো, সব শ্লোগান এখন তার শ্লোগান,
সব মিছিল, এখন তার মিছিল,
সব আগুনে তিনিই একাই ঢেলে দিইয়েছেন বোতলে বোতল নীল কেরোসিন।

মিছিলের এক বাঁকে, ফুটফুটে হাসি মুখের এক ঘর্মাক্ত তরুন এসে জিজ্ঞেস করলো,
পানি চাই , পানি ? আংকেল এক বোতল পানি দেই?
ভেজা টি-শার্ট গায়ে দেবদূতের মতো দেখতে ছেলেটির পবিত্র মুখের দিকে তাকিয়ে
নিঃসন্তান কেরানির খুব ইচ্ছে করে ছেলেটির ভেজা কপালে একটা আলতো চুমু দেয়,
কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা কনকনে ঠান্ডা পানির বোতল তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে
দ্রুত ছেলেটি মিলিয়ে যায় মিছিলের ভিড়ে।

মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত ওদের সাথে এভাবেই সারাদিন
সড়ক, মহাসড়ক, গলি ঘুপচি, পৌর চত্বর আর শিক্ষাঙ্গন ঘুরে ঘুরে
বৃদ্ধ কেরানির এক পর্যায়ে ভীষণ খিদে পায়।
রফিক আজাদ মানচিত্র খেতে চেয়েছিলেন,
বৃদ্ধ কেরানির খেতে ইচ্ছে করে শুধু ধোঁয়া ওঠা সামান্য কিছু গরম ভাত ।
চোখের সামনে গরম ভাতের মিষ্টি ঊর্ধ্বগামী ধোঁয়া আর
উড়ে আসা টিয়ার শেলের দমবন্ধকারী ধোঁয়া মিলেমিশে
তখন কেমন জানি একাকার করে ফেলেছে তার চৈতন্য।
চরম ক্ষুধার মধ্যেই কেন জানি হঠাৎ তার খুব ঘুম পায়।
মিছিলের সব স্লোগান অর উত্তেজনার মধ্যেই আচ্ছন্ন করা ধোঁয়ার ভিতর
ঠান্ডা পানির সেই বোতলটাকে অমৃত ভাণ্ডের মতো স্বযত্নে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে
খোলা রাজপথের ঠিক মাঝখানেই তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন।

ওদিকে মিছিল শেষ হয়ে গেলে, গভীর রাতে
হাসপাতাল থেকে সবগুলো লাশ চোরের মতোন নিয়ে গেছে তাদের স্বস্ব আপনজন।
মেসের কিছু বোর্ডার ছাড়া তার তো কোন চেনা আপনজন নেই,
নেই কোন অভিভাবকও ,
বেওয়ারিশ লাশ হয়ে কখন কিভাবে শুয়ে আছেন তিনি
লাশকাটা ঘরের শীতল মেঝেতে, কোন কিছুই
স্পষ্ট করে তিনি মনে করতে পারেন না।

সম্পর্কের অপ্রয়োজনীয় হিসেব-নিকেশ নিয়ে ভাবতে এখন আর তার ইচ্ছে করে না,
একটি মিছিলই মানুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে তার হিসেবটা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
তবে মনে আছে, সবশেষে তার খুব খিদে পেয়েছিলো, যদিও এখন আর তার মোটেও খিদে নেই,
বরং জীবনানন্দ দাশের সেই বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে
তীব্র ফরমালিনের ঝাঁঝের মধ্যেই বৃদ্ধ
অনুভব করেন জীবনের প্রথম পূর্ণতার স্বাদ।

খুব ভোরবেলা পাখি ডাকার সময় হওয়ার ঠিক আগে
তিনি অস্পষ্ট শুনতে পান,
ভৈরবী রাগে বুঝি গান গাইছে কিছু মিছিলের কণ্ঠস্বর।
জানালা বিহীন বদ্ধ ঘরে অস্পষ্ট আলোয় তিনি দেখতে পান,
মায়াবী বড় বড় চোখের কিশোর মতিউর আবার নেমেছে বুঝি আজও মিছিলে,
আর, মাও সেতুং বারবার দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বিরামহীন বলে যাচ্ছেন,
There can be no construction without destruction.
এত বড় মানুষটাকে, দরোজার বাইরে দাড় করিয়ে রাখতে তার বেশ মজাই লাগছিলো।

শুধু একটা বিষয় নিয়ে তিনি কিছুটা চিন্তিত বোধ করেন,
সেটা হচ্ছে, মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা যখন তার লাশ ডিসেকশান করবে,
তারা কি খেয়াল করবে যে তাঁর ঠোঁটের কোনায় গভীর অর্থবোধক
একটি সাবলীল তীর্যক হাসি ছিলো, আর
তার উদ্যত তর্জনীতে সুস্পষ্ট ও দৃঢ় একটি ইঙ্গিত ছিলো।

২৪ জুলাই, ২০২৪

আরও পড়ুন
মন্তব্য
Loading...