রসিক গোলাম মাওলার সাথে নর্ডিক গ্রামে

মনের মধ্যে একটি নর্ডিক গ্রামের যে ছবিটি ছিলো সেটাই হুবহু  দেখতে পেলাম ক্যাডেট কলেজের প্রিয় ছোট ভাই আসাদ গতমাসে যখন তার ভলভো গাড়ি করে বিশাল বিশাল বার্চ গাছে ভরা বিস্তৃত বনভূমির ভিতর দিয়ে নিয়ে গেলো স্টকহোম থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামে। আমাদের সাথে আছে সুইডেন প্রবাসী আমার বাল্যবন্ধু  রসিক গোলাম মাওলা , যে সুইডিশ পার্লামেন্টের স্পিকারকে তার পুরনো সোফাসেট টানতে বাধ্য করেছিলো আর বার্টান্ড রাসেলের নাতি যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

গ্রামের কেন্দ্রেই বিশাল বিশাল অমসৃণ এবড়ো থেবড়ো ধূসর গ্রানাইট ব্লকের প্রাচীর ঘেরা এই নির্জন প্রাচীন চার্চ। চার্চের এক কোনায় পাদ্রীদের বাড়ি।  বাড়িতে দেখতে পেলাম এক বৃদ্ধা সিস্টারকে। জানালা দিয়ে দেখলাম বাড়ির মধ্যে আরো কয়েকজন সিস্টার। বৃদ্ধা বাদে বাকি সবাই কৃষ্ণাঙ্গ।সুইডেনের উপসালা প্রবাসী বন্ধু গোলাম মাওলা বললো, সুইডেনের মানুষ দিন দিন ধর্মের ব্যাপারে বিরক্ত বা নির্বিকার হয়ে উঠছে, এখন সুইডিশদের মধ্য থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক নান বা সিস্টার আর পাওয়া যায় না তাই প্রধানত আফ্রিকা বা এশিয়া থেকে সিস্টার ইমিগ্রেশন দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। এরা তেমনিই ইমিগ্রেটেড সিস্টার।

এখানে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি, খ্রিষ্ট ধর্ম যিশু খ্রিষ্টের পরলোক গমনের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে রোমে পৌঁছে যায় আর ৩১২ খৃষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইন খ্রিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে মেনে নেয়, এরপর দ্রুত খ্রিষ্ট ধর্ম সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্মকে শক্তিশালী ভাইকিং সংস্কৃতিকে পরাজিত করে নর্ডিক অঞ্চলে ভিত গড়তে প্রায় এক হাজার বছর লেগে যায়। উল্লেখ্য যে এর অনেক আগেই যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পরে আগত ঐ মধ্যপ্রাচ্যেরই অন্য ধর্ম ইসলাম ৭১১ সালের মধ্যেই সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে আমাদের উপমহাদেশে পৌঁছে যায়। মোটামুটি বাংলায় যখন ইসলাম ধর্ম পৌঁছে গেছে প্রায় সমসাময়িক সময়ে খ্রিষ্ট ধর্ম নর্ডিক অঞ্চলে পৌঁছায়। খ্রিষ্ট ধর্ম নর্ডিক অঞ্চলে পৌঁছাতে কেন এতো সময় নিলো এ বিষয়টি আমার কাছে খুবই ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়।

গল্পে ফিরে আসি, মাওলাকে দেখেই বৃদ্ধা সিস্টার বাসার ভিতর থেকে প্রায় দৌঁড়ে এসেই জড়িয়ে ধরলেন ওকে। সুইডিশ ভাষায় ওরা কি কি বললো কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবে এতোটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এরা পরস্পর অনেক অনেক দিনের পরিচিত। আসাদ, সুইডেন প্রবাসী স্থপতি তাওহিদ আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা বলা দেখছিলাম।

আলিঙ্গন পর্ব শেষে মাওলা জানালো সুইডেন আসার প্রাথমিক সময়ে দীর্ঘদিন সে এদের সাথে এ ঘরে বাস করতো। কেন এখানে সে এই প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করতো, কে জানে, তবে কথায় কথায় গোলাম মাওলা বললো যে এখানে বসবাসের সময় রমজানের মাসে এ সিস্টার ওর জন্য সেহেরি আর ইফতারি রান্না করে দিতো। কারো মৃত্যু সংবাদ এলে সিস্টার তাকে কোরান থেকে তিলাওয়াত করতে বলতো। মাওলা সাথে সাথে এ চার্চ চত্বরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সুরা ফাতিহা পাঠ করতো।

সিস্টারের আলখেল্লার কোমড়ের বেল্ট থেকে দেখলাম একটা কালো দানার মাঝারি সাইজের তসবিহর মতো জিনিস ঝুলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা দিয়ে কি করো।  প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম এভাবে জিজ্ঞেস করাটা বোকামি হয়ে গেছে। বৃদ্ধা সিস্টার পরম মমতায় হেসে উত্তর দিলেন,

জেসাস, মেরি, এইসসব নাম জপি।

আমি বললাম,

আমরাও এমন তসবিহ দিয়ে আল্লাহর পবিত্র নামগুলো জপ করি।

তিনি তার সদা হাসোজ্জল মুখেই জবাব দিলেন,

আমি সেটা জানি। মাওলার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

চার্চের পাশেই গ্রানাইট প্রাচীরের ভিতর গ্রামের কবরস্থান। কবরস্থানের পরিপাটি ঘাস আর নানান বর্ণের ছোট ছোট ফুলের সমাহার দেখেই বোঝা যায় জায়গাটাকে এতো সুন্দর রাখতে এদের পরিশ্রম ও মনযোগ কতটা বেশি।

কবরস্থানের ওপারেই মৃদু ঢালের বৃক্ষহীন ভূমির উপর আদিগন্ত বিশাল গমের ক্ষেত। তার ওপারে ঘোড়া, গাঁধা আর মৌমাছির খামার। তাদের খামারে দেখলাম দু’টি গাধা মনের সুখে ঘাস খাচ্ছে। এদের মধ্যে একটি গাধা হঠাৎ খুব সম্ভবত সজাতি ভেবেই বোধহয় দৌঁড়ে একদম আমার কাছে এসে মাথা দুলিয়ে আর কান দু’টিকে খাড়া করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়য়ে কি যেনো বলতে চাইলো আমাকে।

অন্যদিকে প্রলম্বিত নর্ডিক সূর্যালোকে চিকচিক করছে নাম নাজানা একটি হ্রদের জলরাশি। হ্রদের ওপারে সীমাহীন বার্চের বন। তবে নর্ডিক বনকে গহীন জঙ্গল বলা যাবে না,বলতে হবে ভদ্র বনভূমি, কেননা নর্ডিক বনে বৃক্ষের নিচে আমাদের ট্রপিকাল অঞ্চলের বনের মতো লতাগুল্ম বা জংলা গাছ গাছালীতে পরিপূর্ণ হয়ে একে গহীন বা দূর্ভেদ্য করে তুলতে পারে না, তাছাড়া নর্ডিক বনে ট্রপিকাল জঙ্গলের মতো হিংস্র ও ভয়াবহ কোন চতুষ্পদ বা বিষধর সরীসৃপ নেই। তাই নর্ডিক বনের আমাদের বনের মতো জংলী চরিত্র নেই,কোন রহস্যও নেই তবে আছে এক ধরনের স্বচ্ছ, পরিশীলিত ও পরিচ্ছন্ন আবহ।

বহু দূরে দূরে লাল টালির গুচ্ছ গুচ্ছ ঘর দেখা যাচ্ছে। মাওলা আঙুল দিয়ে ইশারা করে করে দেখিয়ে দিচ্ছিলো, ওটা পেট্রিকের বাড়ি আর ঐটা পেট্রিকের সাইলো, ওটা জেমসের বাড়ি, ওটা এরিখের বাড়ি আর ওটা লুকাসের খামার ঘর। আমি অবাক বিস্ময়ে অনুভব করছিলাম আর ভাবছিলাম, এমন সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মাওলা ওদের নাম ও ওদের সাথে তার নানান স্মৃতির গল্প বলছিলো যে, আমার মনে হচ্ছিলো আমি মাওলার গাবতলীর চারিপাড়া গ্রামে বসে আছি আর মাওলা আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছে,  ঐটা ভূঁইয়া বাড়ি, ঐটা হামিদ শেখের বাড়ি, ঐটা জসিম কবিরাজের কাছারিঘর আর ঐটা রজব মোল্লার বাগান বাড়ি।

৪ আগস্ট, ২০২৩

আরও পড়ুন
মন্তব্য
Loading...